এক আল্লাহ জিন্দাবাদ
কাজী নজরুল ইসলাম
আবৃত্তিকার : আকরাম হোসেন
উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।
উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।
হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।
তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।
পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।
দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!
তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।
বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।
হ্যাঁ, লেখো
আমি একজন আরব
আমার কার্ড নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটি সন্তান
নবমটি পরবর্তি গ্রীষ্মে জন্মাবে,
তুমি কি রাগ করলে?
লেখো
আমি এক আরব
সাথী শ্রমিকের সাথে আমি পাথর ভাঙি
অমানুষিক পরিশ্রমে আমি পাথুরে পাহাড় ভেঙ্গে
নুড়ি করি-
এক টুকরো রুটির জন্যে
আমার আট সন্তানের একখানি বইয়ের জন্যে
কিন্তু আমি দয়া-দক্ষিণা চাইনা
আর তোমার কর্তৃত্বের কাছে মাথা নোয়াইনা
তুমি কি রাগ করলে?
লেখো, হ্যাঁ লিখে নাও
আমি একজন আরব
আমি উপাধিহীন একটি নাম
উন্মত্ত পৃথিবীতে এখনও স্থির
স্থান ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে
আমার শিকড় খুব গভীরে প্রোথিত
আমি কৃষকের সন্তান।
নলখাগড়া ও খড়ের তৈরী কুঁড়েঘরে
আমি বাস করি,
চুল আমার মিশকালো,
চোখঃ বাদামী
আমার আরবী শিরোভূষণ
কেড়ে নিয়েছে অনুপ্রবেশকারীর হাত,
আমি পছন্দ করি বোজ্য তেল ও সুগন্ধি লতাগুল্ম
লেখো
এবং সবার উপরে
দয়া ক’রে লিখে রাখো –
আমি কাউকে ঘৃণা করিনা
আমি কেড়ে নিইনি কারো সমুহ সম্পদ,
কিন্তু, আমি যখন অনাহারী
নির্দ্বিধায় ছিঁড়ে খাই
আমার সর্বস্ব-লুন্ঠনকারীর মাংশ
আতএব, সাবধান
আমার ক্ষুধাকে সাবধান
আমার ক্রোধকে সাবধান।
যারা শুধু ধ্বংস করে
মানুষ খুন করার নেশায় পাগল হয়ে যায়
সেই বর্বরদের বিরুদ্ধেই কেবল আমরা অস্ত্র ধরি।
পৃথিবীটাই বদলে গেছে,
প্রবল ভূমিকম্পে উপত্যকার পুষ্প ঝ’রে যাক
তীক্ষè ছুরি সংক্ষিপ্ত করুক পাখির কলগীতি
বারুদের গুঁড়োয় পুড়ে যাক শিশুদের ভ্রু-পল্লব-
মানুষের খুলির ওপর, ধ্বংসের ওপর
সর্বনাশা হায়েনার ছোবলে ছেঁড়াখোড়া জঞ্জালের ওপর
স্ফুলিঙ্গের জন্ম হোক
ভয় নেই, প্রতিটি গৃহে তলোয়ারের টোকা পড়বে।
এসো, তীব্র ঘৃণা এবং ক্রোধের নতুন ঘাম পান কর
এই যুদ্ধ তোমার রক্তে আনুক নতুন জোয়ার
মুখ থেকে তোমার নেকাব খুলে পড়ুক
আজ তোমার মুখ জ্বলন্ত ফুলের মতো
তোমার বোবা অধর বিজয়ের লাল গোলাপের মত।
যদিও তোমার টাটকা জখম থেকে ধোঁয়া উঠছে
আর তার স্বাদ নোনতা
তবু প্যালেস্টাইন, প্যালেস্টাইন আমার, তোমার জয় হোক।
তুমি নিজেই আজ জানাজার কাফন হয়ে যাও
হয়ে যাও রক্তাক্ত ক্রোধ
হয়ে যাও বিভৎস রোষ
তোমার শিরায় শিরায় রক্তের বদলে ব’য়ে যাক নীল গরল
ক্ষমাহীন ঘৃণা
আর তীব্র জ্বালা
আরব জনগণের কাছ থেকে হতাশা তো কবেই পালিয়েছে
আর আমাদের ধৈর্য এখন টগবগ করে ফুটছে
প্রতিটি বদ্ধমুষ্টি ছিঁড়ে ফেলছে সমস্ত বন্ধন
ঘোর আঁধার ভেঙ্গে উদিত হচ্ছে নতুন দিন
সমবেত আকাক্সক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছে বিধানের বন্দনায়,
নির্মল সতেজ ডানা জীবন্ত আর সবুজ
অপেক্ষার ধনুক অধৈর্য
শব সন্ধানী উড্ডীন ঈগলে হায়েনার ক্ষুুধার্ত দাঁত অপেক্ষমান
কত আর অপেক্ষায় থাকব?
পাথরের সুউচ্চ পিরামিড অগ্নিবানে অধৈর্য
কোলাহল-মুখর বিমান বন্দর যেন ঘাতকের নাসিকার গর্জন
প্যালেস্টাইন, তোমার প্রতিটি গৃহই এখন দূর্গ
তোমার প্রতিটি কম্যান্ডো-সন্তান
রণক্ষেত্র থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবে
স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দাশ্রু ঝ’রে-ঝ’রে
পড়বে তোমার গাল বেয়ে,
প্যালেস্টাইন,
তখনই তোমার গগনফাটা উল্লাস।
তদন্ত
মাহমুদ দারবিস
অনুবাদক: রফিক আজাদ
আবৃত্তিকার : আবু দাউদ মু. আরেফিন