মানুষ

মানুষ

গাহি সাম্যের গান–
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ
ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের
জ্ঞাতি ।
‘পুজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পুজার সময়
হলো !’
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-
টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোল বাবা,
খাইনা তো সাত দিন !’
সহসা বন্ধ হল মন্দির , ভুখারী ফিরিয়া চলে
তিমির রাত্রি পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক
জ্বলে !
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পুজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !’
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই
কুটিকুটি !
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে, ‘বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ
নিয়ে সাত দিন !’
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল
মোল্লা–”ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গে-ভাগাড়ে গিয়ে ! নামাজ পড়িস
বেটা ?”
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা !’ মোল্লা হাঁকিল-
‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ !’ গোস্ত-
রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা !
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে–
“আশিটা বছর কেটে গেল,
আমি ডাকিনি তেমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করোনি প্রভু !
তব মজসিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল
দুয়ারে চাবী !”
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায়
কালাপাহাড় ;
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-
দ্ব ার !
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয়
সেখানে তালা ?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি শাবল
চালা !
হায় রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের
জয় !
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল
চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর
করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই
মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !–মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ
কোনো ।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের
মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-
বেশী করে প্রতি ধমনীতে বাজে !
আমরা তাঁদেরি সন্তান , জ্ঞাতি ,
তাঁদেরি মতন দেহ
কে জানে কখন মোরাও
অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ ।
হেস না বন্ধু ! আমার আমি সে কত অতল অসীম
আমিই
কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি,
তোমাতে মেহেদি ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার
দিশা ?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই,
কাহারে মারিছ লাথি ?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন
দিবারাতি !
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ –
দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজানালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয় !
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর -বাসে
জন্মিছে কেহ-জোড়া নাই যার জগতের
ইতিহাসে !
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ,
যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখেনি–হয়ত আসিছে সে এরই
ঘরে !
ও কে ? চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য
জীব !
ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব

আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে,
করিবে নান্দী পাঠ ।
রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা, ও-
হেলা কাহারে বাজে !
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল
সাজে !
চাষা বলে কর ঘৃণা !
দেখো চাষা রুপে লুকায়ে জনক বলরাম
এলো কি না !
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারও ধরিল হাল
তারাই আনিল অমর বাণী–
যা আছে র’বে চিরকাল ।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায়
নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা -নাথ
গিরিজায়া, তা কি চিনি !
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-
মুষ্টি দিলে
দ্বার দিয়ে তাই মার
দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলৈ ।
সে মোর রহিল জমা -
কে জানে তোমারে লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ দু’চোখ স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে,
তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলী ।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা মথিত
সুধা
তাই লুটে তুমি খাবে পশু ?
তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা ?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই
জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের
কোনখানে !
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু ফেলেছে তোমায় মৃত্যু
বিবরে টানি ।

 

 

মানুষ

কাজী নজরুল ইসলাম

আবৃত্তিকার :ফারজানা রেজা স্নিগ্ধা